November 21, 2024, 11:20 am
২০৫০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্ত হতে বাধ্য হবে
জলবায়ুর প্রভাবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রকৃতির বৈরী আচরণে মানুষ আশ্রয়হীন হচ্ছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মিঠাপানির উৎস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে কিছুটা কমলেও তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি থাকে। ফলে উপকূলে তীব্র সুপেয় খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক এলাকায় কৃষি উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে জীবিকা হারিয়েছেন অনেকে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এসব ঝড়ের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। কর্মের আশায় আশ্রয়হীন উদ্বাস্তুরা প্রথমে আশ্রয় নিচ্ছেন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। পেশা বদলের কারণে সহজে কাজ মেলে না বিভাগীয় শহরগুলোতে। এরপর জলবায়ু উদ্বাস্তুদের গন্তব্য হয়ে উঠছে ঢাকার ফুটপাত। সাতক্ষীরায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজিত অ্যাডভোকেসি কর্মশালায় আইপিসিসির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলের ১৭ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্ত হতে বাধ্য হবে। একই সাথে ৪০ শতাংশ জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) সাতক্ষীরা শহরের ম্যানগ্রোভ সভাঘরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউনোপস এর সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা এডুকো বাংলাদেশ ও উত্তরণ এই কর্মশালার আয়োজন করে।
কর্মশালায় বক্তরা বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশেরও কম অবদান রাখা সত্ত্বেও ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর ফলে দেশের দুই কোটি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়ে পড়বে। এছাড়া বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এ ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ।’ প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ২০ বছরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের গড়ে চার লাখ ৬২ হাজার ৪৯১ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সূত্র বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু হবে। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ।
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জলবায়ুর প্রভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাত্র সাত বছরে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। জাতীয় কৌশলপত্রে বাস্তুচ্যুতির জন্য উপকূল ছাড়া অন্যান্য এলাকায় মূলত বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে উদ্ভাস্তু হচ্ছে।
কর্মশালায় বক্তরা বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অবকাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য উপকূলীয় এলাকায় সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়নে আন্তঃমন্ত্রণালয় সংযোগস্থাপনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। ফলে গর্ভবতী মা ও কিশোরীদের উপর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া তাদের উচ্চ রক্তচাপের হার বেড়েছে। তাই নিরাপদ পানীয়জলের স্থায়ী ব্যবস্থা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুর্যোগকালীন আশ্রয় গ্রহণের জন্য সরকার তিনটি বিভাগে ১৬টি দুর্যোগপ্রবণ জেলার ৮৬টি উপজেলায় মোট ২৪৮৭টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এগুলোর মোট ধারণক্ষমতা ১৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ জন-যা ওসব এলাকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটকে জলবায়ু দুর্যোগ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে হবে। প্রতিবেদনে সুন্দরবনকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের রক্ষা কবচ উল্লেখ করে বলা হয়, বিভিন্ন কারণে সুন্দরবন হুমকির সম্মুখীন। উপকূলীয় অঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি, নদীর চর বনায়নসহ সুন্দরবন সুরক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বিশেজ্ঞরা বলছে, জলবায়ু শরণার্থীদের টেকসই পুর্নবাসন করতে হবে। সুপেয় পানির স্থায়ী সমাধান করতে হবে। অভিযোজন প্রক্রিয়া বাড়াতে হবে। উপকূলজুড়ে টেকসই ব্লক বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। কয়লা না, নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে। পাঠ্যবইয়ে জলবায়ু-পরিবেশ শিক্ষা যুক্ত করতে হবে।
Leave a Reply